অচীন দেশের খোঁজে
দীক্ষা ভট্টাচার্য
"আচ্ছা তোরা সবাই অচীন দেশের নাম শুনেছিস?"
"অচীন দেশ... কই না তো, ভূগোলের বইতে আমেরিকা দেখেছি, অস্ট্রেলিয়া দেখেছি, নিউজিল্যান্ড ও দেখেছি... কিন্তু অচীন দেশ, সে আবার কোথায়?"
"রাখ তোদের ভূগোল বই, সবই যদি বই এ পাবি তাহলে আর আমার কাছে গপ্পো শুনতে আসা কেন?"
"না, না, ভুল হয়ে গেছে, তুমি বলো অচীন দেশটা কোথায়?"
"হুমম, তা অচীন দেশ যেতে গেলে সাত সমুদ্দুরের মধ্যে তিন সমুদ্দুর আর তেরো নদীর মধ্যে পাঁচটা নদী পার হয়ে ভুশুন্ডির মাঠে নামতে হয়, সেখান থেকে তেপান্তরের মাঠের সোজা ম্যাজিক কার্পেট যায়, তাতে চড়ে সাড়ে সাত মিনিট গেলেই অচীন দেশের পাঁচিল দেখতে পাওয়া যায়, ব্যাস কার্পেট দাঁড় করিয়ে তাতে নেমে পড়তে হবে।"
"পাসপোর্ট, ভিসা কিছু লাগবে না"
"হা হা, না রে, তবে ওখানে যেতে ওখানের রানীর চিঠি সঙ্গে থাকতে হয়, আর সে চিঠি সবাই পায় না, যে পায় সেই যেতে পারে, এবার থাম আর আমায় শুরু করতে দে গপ্পোটা... আজ থেকে অনেক বছর আগে অচীন দেশের রাজা মশাই পড়েছেন বড় বিপদে...
********
অচীন দেশের প্রজারা বড়ই চিন্তায়, তাদের চিন্তা দেখে কোটাল চিন্তায়, সেই দেখে মন্ত্রীমশাই চিন্তায়, শেষে সব দেখে রাজামশাই মহা চিন্তায়। আসলে হয়েছে কি, রাজা মশাই এর বিয়ে হয়েছে তা বছর চারেক কিন্তু এখনো রানী মায়ের কোল আলো করে রাজকুমার এলনা। রাজ বৈদ্যের পথ্য থেকে রাজ পুরোহিতের পুজো কিছুতেই কিছু লাভ হয়নি। তা ও যদি আর কয়েক বছর আগের ব্যাপার হত রাজামশাই টুক করে রানীমা কে দুয়োরানী বানিয়ে সুয়োরানী কে বিয়ে করতেন। কিন্তু দেশের আইন কানুন যা কড়া হয়েছে তাও এখন সম্ভব নয়। অগত্যা দেশ বিদেশে রাজার দূত ছুটল উপায় জানতে।
তেপান্তরের মাঠ পার হয়ে আজবগড়ে যাওয়ার পথেই ব্যঙ্গমার সাথে দূত মশাই এর দেখা। প্রথমে তো দূত বাবু কিছু বলতেই চাইছিল না, তবে ব্যাঙ্গমা ও কি ছাড়ার পাত্র, ঠিক পেট থেকে খবর বের করল। তারপর তো জানা গেল ব্যাঙ্গমীর ও নাকি এই এক ই সমস্যা ছিল, দূতের কানে কানে কি সব শলা ও দিল বলে। দূত তো সব শুনে বেশ খুশি হয়েই আবার অচীন দেশের উদ্দেশ্যে নিল ইউ টার্ন, মনে আশা যে এই টোটকায় কাজ হলে রাজা মশাই একেবারে খুশি হয়ে আধা রাজত্বই না দিয়ে দেন।
দূতের বলে দেওয়া টোটকা মত রানীমা তো রোজ ভোর বেলা সূয্যি মামা উঁকি দেওয়ার আগে চোখে কাপড় বেঁধে ঘুম থেকে উঠে একটা পাকা আম কে দু আধখানা করে এক টুকরো নিজে আর এক টুকরো রাজা মশাইকে খাইয়ে তবেই চোখের কাপড় খুলতেন।
এক মাস যেতে না যেতেই রাজ বাড়িতে হইহই, রানীর কোল আলো করে রাজপুত্তুরের আসার খবর শুনে রাজামশাই তো দূতের নামে পাঁচটা গ্রাম ই লিখে দিলেন।
দেখতে দেখতে দিন কাটে, অপেক্ষার দিন ও এগিয়ে আসে, প্রজাদের সঙ্গে রাজা মশাই ও উদগ্রীব অপেক্ষায় নতুন কুমারের জন্য।এরই মধ্যে ধাইমা ভেতর থেকে এসে জানান রানীমার সন্তান জন্মানোর খবর।
কিন্তু এ কি, যে খবরে সারা রাজ্য জুড়ে আনন্দ উৎসব হওয়ার কথা ছিল তা শোনার পর আরো অন্ধকার কেন নেমে এল?মন্ত্রিমশাই মাথায় হাত দিয়ে অমনি বসে পড়লেন কেন নিজের আসনে। দূত ভায়া ও কেমন মানে মানে কেটে পড়ার তালে আছে মনে হচ্ছে... আর রাজা মশাই....
রাজমশায়ের মনে তখন অন্য ঝড়, আরে এর থেকে ভালো বুম্বাগড় এর রানীর মত যদি তার রানী কুকুর বিড়ালের জন্ম দিতেন, তা ও বোঝা যেত কোনো শাপ পড়েছে, পরে না হয় তারা রাজপুত্র হয়ে রাজ্য দেখভাল করত.... তাই বলে কন্যাসন্তান... এ কি অনাসৃষ্টি কান্ড রে বাবা।
রাজার রোষে দূতের প্রাণ যায় যায়, কান টানলে মাথা আসার মত ব্যাঙ্গমা কে ও ধরে আনা হয়েছে, সে তো সব শুনে সোজা বলে দিল দূত শুনতে ভুল করেছে, চোখের বাঁধন রাজা মশাই কে বাঁধতে হত রানীমা কে না।
এই বলে সে তো ফুড়ুৎ
এই সব গোলমালের মধ্যেই আসতে আসতে বড় হতে থাকল রাজকুমারী আয়না, ততদিনে তার একটি ভাই ও হয়েছে, রাজকুমার দর্পণ। পরের বার আর রাজামশাই ভুল করেননি আর কি।
তা দর্পণ বয়েসে কচি হলেও তার বিক্রম দেখার মত, ছোটো থেকেই মেঘ না চাইতে জল পেলে যা হয়। দিদি তো দূর,মায়ের কথাও সে কানে নেয় না। বাবা কে খানিক মেনে চলে বটে, তবে বাবারই বা ছেলে কে শাসন করা হয় কোথায়।
এদিকে রাজকুমারী আয়না কিন্তু রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী, রাজা মশাই কিন্তু মেয়েকেও এখন ভালোই বাসেন। কিন্তু ওই খেতে বসে বেশি ভালোটা ভাইয়ের পাতে, আর দামী খেলনাগুলো ভাইয়ের দেখতে দেখতে আয়নার ও অভ্যেস হয়ে গেছে।
এরই মধ্যে একদিন 'আলখ নিরঞ্জন' বলতে বলতে এক সাধুবাবা এসে হাজির রাজার দুয়ারে, প্রথমেই তিনি দর্পণের সামনে, ঝুলি বাড়িয়ে যেই না ভিক্ষা চেয়েছে সে করেছে কি দিচ্ছি সাধুবাবা বলে রসুই খানা থেকে মাছ এনে সোজা সাধুর ঝোলায়।
ব্যাস... আর যায় কোথায়, সাধুবাবা তো রেগে কাই, হয়তো দর্পণকে ভস্মই করে দিতেন, নেহাৎ ছোটো বলে তা না করে শাপ দিলেন
"দুরাচারী শিশু ওরে বলি তোরে শোন
এখনো সময় আছে বাঁচাতে জীবন
সবাইরে সবসময় করিস অশ্রদ্ধা
ভেঙে গুড়িয়ে যাক তোর এই স্পর্ধা"
ব্যাস, প্রতাপ একেবারে সঙ্গে সঙ্গে কেমন ভেঙে চুরে গিয়ে অষ্টাবক্র মুনির মত বেঁকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এদিকে রাজকুমারী আয়না ঠিক ওই সময়েই ওদিক দিতে যাচ্ছিল, ভাইয়ের শাপ পাওয়া দেখে সে তো ছুটে এসে একেবারে সাধুবাবার পায়ে, অনেক কাকুতি মিনতি করে তার রাগ একটু কমের দিকে, কিন্তু দর্পণ কে আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক করতে তিনি নারাজ। এদিকে রাজামশাই, রানীমা সব ছেড়ে ছুটে এসেছেন।
সবার কান্নাকাটির মাঝে সাধুবাবা রাজা মশাই কে বলে উঠলেন,
"হে রাজন, রতন ঘরেতে তোমার, চিনিতে নাহি পারো
হীরা ফেলে কাঁচ টুকরাকে করো যে ধারালো
পুত্র আর কন্যাতে যে নাই ভেদাভেদ
মনুষ্যেতর পশুও করেনা এই ভেদ"
সাধুবাবার কথা শুনে রাজমশায়ের মাথা হেঁট হয়ে যায়, তিনি কিছু বলার আগেই সাধুবাবা বলে ওঠেন তিনি দর্পণ কে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেবেন যদি রাজামশাই রাজি হন রাজকুমারী আয়না কে সমান অধিকার দিতে...
রাজামশাই ও আর উপায়ন্তর না দেখে রাজি হয়ে যান, আর সেই থেকেই আয়না আর দর্পণ সমান সমান। এমনকি দুজন বড় হলে প্রজাদের ভোটাভুটি হয়ে রাজকুমারী আয়নার হাতে এল অচীন দেশের রাজ্যপাট। তার রাজত্বে প্রজারাও সুখে, রাজা রানিমা এখন দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ান ম্যাজিক কার্পেটে চড়ে।
আর দর্পণ কুমার, তিনি এখন তার দিদির চিফ এডভাইজার, দুজনে মিলে দিব্যি সামলায় সবকিছু।
********
"তারপর, তারপর কী হল?"
"তারপর নটে গাছ টি মুড়োলো, এবার যা তোরা, আবার কাল নতুন গপ্পো শোনাবো"
বাচ্চাগুলির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে গিয়েও আটকে যায়
"কি রে বাবলি, বাড়ি যাবি না?"
"ধুর গেলেই মা ঘরের কাজে লাগিয়ে দেবে, এদিকে ভাইকে দেখো... গল্পদিদা ওই সাধুবাবাকে আমার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দেবে গো?"
বাবলি কে জড়িয়ে ধরে বুকে ভাঙন ধরে পাড়ার সবার প্রিয় গল্পদিদার, সত্যিই তো এই সাধুবাবার খোঁজটা যদি জানা থাকতো, যে এক নিমেষে জাদু কাঠি বুলিয়ে সব ভেদাভেদ মিটিয়ে দেবে... দেশটা সত্যিই রূপকথার অচীন দেশ হয়ে যেত।
আপনি জানেন না কি সেই সাধুবাবার খোঁজ?